Kadambini Ganguly: First Female Doctor in India
Aniket Mandal, Third-Year Undergraduate, IIT Kharagpur
যে সময় ভারতীয় মেয়েদের কর্মজগতের, এমনকি পড়াশুনোর রাস্তাটাও ঠিকভাবে তৈরী হয়নি, পর্দার আড়ালে বা বাড়ির অন্তৰ্মহল অবধিই যখন ছিল নারীদের আনাগোনা, তখন সমাজের রক্তচক্ষু আর প্রাচীনপন্থীদের যাবতীয় সমালোচনাকে ধূলিসাৎ করে প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তারের উপাধি অর্জন করে নিতে পেরেছিলেন যিনি, তিনিই কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। সেকালের রক্ষণশীল সমাজেও রাতবিরেতে রোগী দেখতে গেছেন ফিটনে চেপে, প্রাইভেট চেম্বার খুলে কাগজে তার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, অস্ত্রোপচার করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
এহেন মহীয়সী নারীর জন্ম 18 জুলাই 1861 তে, বিহারের ভাগলপুরে। বাবা ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক, ব্রজকিশোর বসু ছিলেন নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা। বাবার এই মুক্তমনা চিন্তাধারার প্রভাব পড়েছিল কাদম্বিনীর মধ্যে।
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর কাদম্বিনীর পিসতুতো দাদা মনোমোহনের হাত ধরে পড়াশুনো আরম্ভ করেন 'হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে'। 1876 খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়'-এ ভর্তি হন, 2 বছর পর যেটিকে বেথুন স্কুলের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এখান থেকেই 1876 খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহিলা হিসেবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। কিন্তু এরপর প্রশ্ন ওঠে, উচ্চশিক্ষার জন্য কোথায় ভর্তি হবেন তিনি ?
কাদম্বিনীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং সেখানে প্রথমে এফ.এ. (Degree of Fine Arts) এবং পরে অন্যান্য স্নাতক শ্রেণী আরম্ভ করা হয়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি আর চন্দ্রমুখী বসু, দেশের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন, 1883 খ্রিস্টাব্দে।
এবার কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তারি পড়বেন। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী আঁতকে উঠলো, শুরু হলো আরও এক ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ আর লড়াইয়ের ইতিহাস। মেডিক্যাল পড়তে চেয়ে কাদম্বিনী 1881 খ্রিস্টাব্দে আবেদন করেন, কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ কাউন্সিলের কোনো হেলদোল দেখা যায় না। অবশেষে 1883 খ্রিস্টাব্দের 29 জুন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন কাদম্বিনী। ইতিমধ্যে অন্যতম ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক, তাঁরই শিক্ষক দ্বারকানাথ এর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে কাদম্বিনীর। সেই সময়ের সমাজে একজন নারীর চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষার নিয়ে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, কলেজের মেডিসিনের শিক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত ও ছিলেন তাদের মধ্যে। ব্যাচেলর অফ মেডিসিন (MB) পরীক্ষায় নিজের পেপারে ইচ্ছাকৃত ভাবে এক নম্বরের জন্য তিনি কাদম্বিনী কে ফেল করিয়ে দেন। তবে অধ্যক্ষ জে এম কোটস এর হস্তক্ষেপে তাকে জিএমসিবি বা ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ উপাধি দেওয়া হয়। ফলতঃ আনন্দীবাঈ যোশীর সাথে প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসকদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠার কৃতিত্ব অর্জন করেন কাদম্বিনী।
প্রথমে ইডেন হাসপাতাল, পরে 1890 খ্রিস্টাব্দে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে মাসিক 300 টাকা বেতনে কাজের সুযোগ হয়। তবে শুধু হাসপাতালের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না কাদম্বিনী, প্রাইভেট প্র্যাক্টিসও করতেন 1888 থেকেই। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ বা ‘বেঙ্গলি’র মতো কাগজে নিয়মিত তার প্র্যাক্টিসের বিজ্ঞাপন বেরোত।
কিন্তু এম.বি. ডিগ্রি না পাওয়াটা সম্ভবত কাঁটার মতো তাঁকে বিঁধছিল। কারণ, বিরোধীরা প্রতি পদক্ষেপে ওই বিষয়টিকে তুলে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে বিদ্রুপ এবং তাঁকে চিকিৎসকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করছিলেন। তৎকালীন রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে কাদম্বিনী তার আট সন্তানদের তার বড় বোনের কাছে রেখে 1893 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। অবিশ্বাস্য ইচ্ছাশক্তি, দ্বারকানাথের অবিচ্ছিন্ন সমর্থন এবং লন্ডনে অবস্থিত তাঁর এক আত্মীয় ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের সহায়তায় কাদম্বিনী এডিনবরার স্কটিশ কলেজে মেডিকেল সায়েন্সে ট্রিপল ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন এবং দেশে ফেরেন কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস, এডিনবরা (এলআরসিপি); কলেজ অফ সার্জনেস, গ্লাসগো (এলআরসিএস); এবং এলএফপিএস-এর মর্যাদাপূর্ণ যোগ্যতা নিয়ে। সে বছর 14 জন সফল প্রার্থীর মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা, এবং ডিগ্রিগুলি অর্জন করেছিলেন তিনি অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। কাদম্বিনীই ছিলেন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রিধারী প্র্যাক্টিসিং মহিলা চিকিৎসক। তাঁর এহেন কৃতিত্ব আর অধ্যবসায়ের খবর গেছিল স্বয়ং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল এর কাছে। 1888 খ্রিস্টাব্দে এক চিঠিতে তিনি লেখেন -
“Do you know or could tell me anything about Mrs Ganguly, or give me any advice? She has already passed what is called the first licentiate in medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination in March next. This young lady, Mrs. Ganguly, married after she made up her mind to become a doctor and has had one, if not two children since. But she was absent only thirteen days for her lying-in and did not miss, I believe, a single lecture!”
তবে শুধু চিকিৎসাক্ষেত্রেই তো আর না, সমাজ সংস্কার তথা সামাজিক আন্দোলনেও সমান ভাবে পা বাড়িয়েছেন কাদম্বিনী। বন্যাত্রাণে, বস্তিবাসীদের দুর্দশা তাকে টেনে নিয়ে গেছে তাদের মধ্যে। দুঃস্থ বস্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন দাতব্য চিকিৎসালয়। 1889 খ্রিস্টাব্দে বোম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন কাদম্বিনী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। 1905 খ্রিস্টাব্দে যখন বাংলাকে বিভক্ত করা হয়েছিল, কাদম্বিনী কলকাতায় এক মহিলা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন এবং 1908 খ্রিস্টাব্দে এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরে তিনি প্রকাশ্যে সত্যাগ্রহকে সমর্থন করেন এবং শ্রমিকদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য লোককে সংগঠিত করেছিলেন।
নেপালের রাজা জঙ বাহাদুরের মা এক বার খুব অসুস্থ হলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে কাদম্বিনীকে ডেকে পাঠানো হল। তাঁর ওষুধে রাজমাতা সুস্থ হলেন। ফেরার সময়ে রাজমাতাকে সারিয়ে তোলার পুরস্কার হিসেবে প্রচুর অর্থ, দামী পাথর বসানো সোনার গহনা, মুক্তোর মালা, রুপোর বাসন, তামা-পিতল-হাতির দাঁতের জিনিস আর একটি সাদা রঙের গোলগাল, জ্যান্ত টাট্টু ঘোড়া দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপেই তিনি কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রোগী দেখতে ছুটতেন। কবি কামিনী রায়ের সাথে কাদম্বিনী দেবী 1922 খ্রিস্টাব্দে বিহার ও ওড়িশার নারী শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হন কাদম্বিনী দেবী।
1923 খ্রিস্টাব্দের 3 অক্টোবর একটি অপারেশন সেরে বাড়ি ফিরে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু ঘটে কাদম্বিনী গাঙ্গুলির। সেদিন ও দক্ষ হাতেই অস্ত্রোপচার করেছিলেন তিনি, পুত্রবধূ সরলাকে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘‘আজকের অপারেশন দেখলে আর কেউ বলতে পারবে না যে, ডাক্তার গাঙ্গুলির আর অপারেশনের হাত নেই।" আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ছিলেন নারী শিক্ষা এবং অধিকারের স্বর, তাঁর হাত ধরেই মেডিক্যাল শিক্ষায় ছেলেদের সাথে টেক্কা দিয়ে মেয়েরাও শিক্ষা অর্জনের পথ করে নিতে পেরেছে। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’, এই প্রবাদের তিনি যে জ্বলন্ত উদাহরণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
রেফারেন্স :
Comments
Post a Comment