কোভিড-যুদ্ধে টিকার অস্ত্র

 


প্রোজ্জ্বল গাঙ্গুলী




গোড়ার কথা:-


কোভিড-19. গত দু'বছর যাবৎ রোগখানা সারা বিশ্বকেই তটস্থ করে রেখেছে। চারিদিকে শুধু মৃত্যু-মিছিল আর হাহাকার। লোকজনের মুখে উঠেছে মাস্ক, আর হাত ধুতে ধুতে সবাই বলে চলেছে 'আরো দূরে চলো যাই' । এই অবস্থায় এবছর 16 ই জানুয়ারি থেকে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে কোভিড‐19 এর টিকাকরণ। এই লেখাখানায় টিকাকরণের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো:-


  • সাধারণ টিকা-talk:-


  1. টিকা হল আমাদের শরীরের অনাক্রম্যতা তন্ত্রের একটা বাড়তি অস্ত্র।

  2. জন্ম থেকেই আমাদের দেহে কিছু ব্যবস্থা থাকে যা আমাদের বাইরের ক্ষতিকারক জিনিস থেকে রক্ষা করে চলে- যেমন ত্বক, চোখের জল, লালারস, পৌষ্টিক নালীর অম্লতা বা ক্ষারধর্মিতা প্রভৃতি।

  3. এছাড়াও রয়েছে কিছু অতন্দ্র প্রহরী - যাদের বলে লিম্ফোসাইট, ম্যাক্রোফাজ়, ন্যাচারাল কিলার কোষ প্রভৃতি। যদি কোনো বহিঃশত্রু কোথাও ফাঁক পেয়ে শরীরে ঢুকে পড়ে, এদের চোখে পড়লে আর নিস্তার নেই।

  4. কিন্তু এদের যদি চোখ এড়িয়ে যায়? বা এরা যদি শত্রুকে চিনতেই না পারে? তখন বাইরে থেকে শত্রুসেনার একখানা প্রতিচ্ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয় শরীরে। এই প্রতিচ্ছবি খানার কাজ অনেকটা লুক আউট নোটিশ এর মতো। শরীরের স্বাভাবিক অনাক্রম্যতাতন্ত্র এই প্রতিচ্ছবিখানা চিনে রেখে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নেয়। এবার শত্রু ঢুকলেই গোলাগুলি চালিয়ে মেরে ফেলবে। 

  5. এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে বাইরে থেকে পাঠানো এই প্রতিচ্ছবিখানা কী? হ্যাঁ, এটাই হল টিকা।

  6. সাধারণত টিকায় ব্যবহার করা হয় উদ্দিষ্ট রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের মৃত প্রতিলিপি যা বিভাজনক্রম, অথবা জীবিত প্রতিলিপি যা রোগ সৃষ্টিতে অক্ষম, কখনো আবার শুধুই জীবাণুটির কোষীয় গঠনের প্রতিরূপ। 

  7. আমাদের অনাক্রম্যতাতন্ত্র টিকা থেকে পাওয়া প্রতিলিপিটিকেও বহিঃশত্রু বলেই বিবেচনা করে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে অ্যান্টিজেন। আর এই অ্যান্টিজেনের উপযুক্ত অ্যান্টিবডি বানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যেমন সেটিকে নষ্ট করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে অ্যান্টিজেনটির স্মৃতি ধরে রেখে দেয় বি-লিম্ফোসাইট কোষ। দ্বিতীয়বার অ্যান্টিজেন ঢুকে পড়লে শরীরে-- হুঁ হুঁ বাবা-- পালাবার পথ পাবে না। 

  8. বিভিন্ন টিকার কার্যক্ষমতা বিভিন্ন রকম হয়। কোনো টিকা একবার নিলেই কাজ চলে, আবার কোনো কোনো টিকা একাধিকবার নিতে হয় উপযুক্ত মাত্রায় অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করতে। 

  9. বিভিন্ন টিকার কার্যপ্রণালীও বিভিন্ন হয়। কেউ রোগের সংক্রমণ ঘটলেও বাড়াবাড়ি হতে দেয় না, কেউ কেউ রোগটির ফিরে আসা আটকায়। 


  • কোভিডের টিকা-talk:-


 ভারতবর্ষে এখনও পর্যন্ত যে দুটি টিকা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সেই দুটি টিকার বিভিন্ন দিক নিয়ে এখানে বলা হল - 


  1. Covishield :

প্রস্তুতকারক : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রোজেনেকা, ভারতে সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া


ব্যবহৃত বস্তু : ডি এন এ প্রতিলিপিকরণ (Replication) ক্ষমতারহিত সিমিয়ান অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর(চ্যাডক্স-1) 


কিভাবে কাজ করে : ভেক্টরটিতে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন গঠনকারী জিনটি সংযুক্ত রয়েছে। কোষীয় কার্যপ্রণালীর সহায়তায় সেটি স্পাইক প্রোটিনটি তৈরি করে। এই স্পাইক প্রোটিনটি এ সি ই - 2  উৎসেচকের সহায়তায় অতিঅনাক্রম্যতার সৃষ্টি করে থাকে। ফলে ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ঘটলে স্পাইক প্রোটিন শনাক্ত করে শরীরী অনাক্রম্যতা রোগ সংক্রমণকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে । 


  1. Covaxin :

প্রস্তুতকারক : ভারত বায়োটেক


ব্যবহৃত বস্তু : সার্স কোভ-2 (কোভিড-19 জীবাণু) - এর একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিরূপ 


কিভাবে কাজ করে :  যেহেতু সরাসরি ভাইরাসটির নিষ্ক্রিয় প্রতিলিপি ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে শরীরী অনাক্রম্যতা তন্ত্র সহজেই ভাইরাসের আক্রমণ ঘটলে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। 


শেষকথা:-


             একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। কোনো টিকাই ১০০% সুরক্ষা দিতে পারেনা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সতত পরিবর্তনশীল, প্রতিনিয়ত নতুন গবেষণার আলোকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করেই তার পথচলা। এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিকেরা জানাচ্ছেন, টিকাকরণের পর রোগের আক্রমণ ঘটলেও টিকাগুলি আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগ সংক্রমণকে প্রাথমিক পর্যায়ে রুখে দিচ্ছে, অক্সিজেন সম্পৃক্তি (saturation)-র ঘাটতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ভাইরাসের নতুন নতুন পরিব্যক্ত (mutated) স্ট্রেনের ক্ষেত্রেও টিকাগুলির কার্যকারিতার প্রমাণ অনেক গবেষণায় পাওয়া গেছে। 

                এই মহামারী রোধে আমাদের হাতে এখন টিকার মতো ব্রহ্মাস্ত্র এসে হাজির হয়েছে। টিকাকরণ অগ্রসর হলে আমরা গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা (Herd immunity)-র দিকে অগ্রসর হব, যা সংক্রমণের ভবিষ্যৎ রেখচিত্রকে অনেকটাই পাল্টে দেবে। তাই সকলের কাছে অনুরোধ, সুযোগ এলেই টিকা নাও, প্রতিটি টিকাই গবেষণার কষ্টিপাথরে অনেকবার যাচাই করে জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সকলকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলো, গুজবে কান দেওয়ার দরকার নেই। বিজ্ঞানের আলোয় তথ্যগুলো যাচাই করে দেখো, তারপর নিজেই সিদ্ধান্ত নাও।। 






Comments

Popular posts from this blog

নিশিরাত, স্ট্রীট ল্যাম্প এবং পোকা

অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা

কোভিড-19 : গুজব এবং সত্যতা