কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ : আলাদা কোথায় জানো কি কেউ?

 Arnab Talukder, কলকাতা মেডিকেল কলেজ


    অতিমারির ধাক্কায় এতদিনে‌ তোমরা প্রায় সবাই কোভিড সংক্রান্ত সাধারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে অবগত হয়েছ। সেগুলো আবার নতুন করে বলার জন্য এই লেখা নয়। কোভিডের প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের এ যাবৎ যে বৈপরীত্যসূচক বিষয়গুলো আমার নজর কেড়েছে মূলত সেগুলোই লিখতে বসেছি। 


    ইতোমধ্যে করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিধ্বস্ত দেশ। এই  লেখা তৈরির সময়ে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি মিনিটে প্রায় 48 জন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রতি মিনিটে মৃত্যু হচ্ছে গড়ে 1 জনের বেশি মানুষের (13 জুনের হিসেব অনুযায়ী)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গোটা  বিশ্বে করোনা আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক ভারতের বাসিন্দা এবং মোট মৃতের 25 শতাংশই এ দেশের। দ্বিতীয় ঢেউয়ের লেখচিত্র নিম্নগামী হলেও, আমরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও সর্বত্র লক্ষ্য করেছি কোভিডের ব্যাপক সংক্রমণ, মৃত্যুর হাহাকার আর রোগীর প্রাণ বাঁচাতে পরিজনদের মরিয়া প্রচেষ্টা। প্রত্যেকই আতঙ্কিত কখন তার অথবা পরিজনের অসুস্থ হওয়ার পালা আসে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল না থাকায় বেড মেলেনি মুমূর্ষু রোগীদের, মেলেনি ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকুও। ওষুধ নিয়ে চলেছে কালোবাজারি। শ্মশানে, কবরস্থানে মৃতদেহের সারি। জ্বলেছে গণচিতা। গাদাগাদি করে মৃতদেহ বয়ে এনেছে অ্যাম্বুলেন্স। শবদেহ ছিঁড়ে খেয়েছে রাস্তার কুকুর। শুধু সাধারণ মানুষ নন, মারা গেছেন চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরাও। দ্রুত রোগের প্রকোপ কমাতে প্রয়োজন ছিল যে ব্যাপক টিকাকরণের, সেই কাজও চলছে নিতান্তই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, প্রায় না-চলার মতো করে। 


    কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে অজানা আতঙ্ক (anxiety) ছিল অনেক বেশি, ভয়াবহতা ছিল কম। দ্বিতীয় ঢেউয়ে আতঙ্ক (fear) গেল কমে, তুলনামূলকভাবে ভয়াবহতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। এর পিছনে কার্য-কারণ সম্পর্কগুলো যদি আমরা খুঁজি তবে দেখব-


1. আমাদের দেশে প্রথম ঢেউয়ে প্রধানত একই ধরনের করোনা ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা যেভাবে ক্রমাগত তার রূপের পরিবর্তন ঘটিয়েছে (যাকে আমরা বিজ্ঞানের পরিভাষায় মিউটেশন-Mutation বলে থাকি) তাতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় 200 রকম বৈচিত্রের করোনা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে প্রধানত রয়েছে UK strain, South African strain, Brazilian strain এবং Double Mutant strain.


2. এই ঢেউয়ে এই নতুন রকমের ভাইরাসগুলোর একজনের থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা প্রথমবারের তুলনায় অনেক গুণ বেশি, যে কারণে এবার খুব দ্রুতগতিতে অনেক কম সময়ের মধ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এইবারে একবার কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যাও আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্ত হওয়া এবং মারাত্মক অসুস্থতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে অনেকাংশে কমানো গেলেও, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনকি মারাও যাচ্ছেন (যদিও সেই সংখ্যাটা অনেকটাই কম)।


3. নবউদ্ভূত ভাইরাসগুলো দ্বিতীয় ঢেউয়ে বয়স্কদের পাশাপাশি 20 বছর থেকে 40 বছর বয়সি মানুষদেরও বিপুলভাবে আক্রমণ করছে। এরূপ পরিস্থিতি প্রথম ঢেউয়ে তৈরি হয়নি।


4. প্রথমবারে দেখা গেছে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন অসুস্থতার লক্ষণ প্রদর্শন এর গড় সময় (incubation period) ছিল 2-14 দিন, যেটা এবার কমে এসে দাঁড়িয়েছে 4-5 দিন।


5. অনেক ক্ষেত্রে এমন তথ্যও উঠে এসেছে যে RT-PCR পরীক্ষাতে অনেক নতুন mutant strain কে বোঝা যাচ্ছে না। অথচ রোগীর মধ্যে করোনার সমস্ত লক্ষণ উপস্থিত এমনকি ফুসফুসের HRCT (High-Resolution Computed Tomography) করে দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক রকমের সাদা স্পট (স্বাভাবিক অবস্থায় ফুসফুস বায়ু দ্বারা পরিপূর্ণ হাওয়ায়, সমগ্র ফুসফুস X-ray অথবা HRCT তে কুচকুচে কালো রঙের দেখায়), যা ক্রমশ ফুসফুসের বাইরের দিক থেকে hilum এর দিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে।


6. এছাড়াও দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় সকল রোগীদের রক্তে D-Dimer (সমগ্র শরীরে রক্ত তঞ্চনের পরিমাপক) এর ঘনত্ব অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ Thrombotic Complications (অপ্রয়োজনীয় রক্ততঞ্চন প্রক্রিয়া) হচ্ছে, যা প্রথম ঢেউয়ে খুব একটা বেশি হয়নি। আবার চিকিৎসা করতে গিয়ে anticoagulant (রক্ত তঞ্চন আটকাতে) দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, অনেক প্রয়োজনীয় তঞ্চন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায়, শরীরের বেশ কিছু জায়গায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে।


7. Co-morbidity না থাকা রোগী তথা সামগ্রিকভাবে মৃত্যুহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এই ঢেউয়ে। বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে কোভিডের মোকাবিলা করতে গিয়ে শরীরের অনাক্রম্যতা (Immune System) দ্রুত এতটাই অতি সক্রিয় হয়ে পড়ছে যে, তাতে ভালোর চেয়ে মন্দ বেশি হচ্ছে। প্রতিরোধী কোষগুলি ভাইরাসকে মারতে প্রচুর পরিমাণে  বিভিন্ন রকম cytokine ক্ষরণ করছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে 'সাইটোকাইন (Cytokine) ঝড়'। কোভিড ভাইরাসের কারণে যত না মানুষ মারা যাচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে এই 'cytokine ঝড়' উদ্ভূত সমস্যার কারণে। ফুসফুসে জল জমে গ্যাসীয় আদান-প্রদান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে, যে কারণেই শরীরে দেখা যাচ্ছে অক্সিজেনের ঘাটতি। অতি সক্রিয় অনাক্রম্যতাকে (Immunity System) কমানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে (অনেক রকম জটিলতা সত্ত্বেও) স্টেরয়েড। বিষয় বহির্ভূত একটা কথা এখানে বলতেই হয় যে, মূলত অধিক স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার জন্য দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ছত্রাকের (মিউকরমাইকোসিস-Mucormycosis) আক্রমণ (Secondary Infection)।


    এ তো গেল কোভিড রোগের বিজ্ঞান। এই অতিমারি উদ্ভূত যে সামগ্রিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার পিছনেও রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট কার্য-কারণ সম্পর্ক। এমন দুর্দশা যে হতে চলেছে সকলেরই তা জানা ছিল। যে সমস্ত দেশে ভারতের আগেই দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল, তাদের দেখেই পূর্বাভাস পেয়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ আসতে চলেছে। সরকারি প্রশাসনের উঁচুতলার অফিসাররা জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকেই সংক্রমণ বাড়ছে বলে সরকারকে সতর্ক করার কাজ তারা শুরু করে দিয়েছিলেন। অথচ সরকার সে কথায় আদৌ গুরুত্ব দেয়নি। এই অবস্থায় প্রয়োজন ছিল আপৎকালীন ভিত্তিতে দ্রুত হাসপাতালগুলির বেড বাড়ানো, অস্থায়ী কোভিড হাসপাতাল তৈরি করা, পর্যাপ্ত সংখ্যায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা, প্রয়োজনীয় পরিমাণ ওষুধ মজুত রাখার ব্যবস্থা করা এবং দ্রুতগতিতে টিকাকরণের ব্যবস্থা করা -- যার কিছুই প্রায় করা হয়নি!

    এই পরিস্থিতিতে মানুষ ভেবেছিল, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে সরকার জরুরি ভিত্তিতে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করবে, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করবে এবং বিনামূল্যে দেশের সমস্ত মানুষকে টিকার আওতায় আনার ব্যবস্থা করবে। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যখন টিকার জন্য হাহাকার শুরু হল, তখন দেখা গেল দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা তো নেই-ই, উপরন্তু সরকার নিজে কোনও উদ্যোগ না নিয়ে কয়েকটিমাত্র বেসরকারি কোম্পানির ওপর নির্ভর করে বসে রয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরছে মানুষ। হাসপাতালের পথে দম বন্ধ হয়ে এলে স্বামীর মুখে ফুঁ দিয়ে স্ত্রীর অক্সিজেন জোগানোর মরিয়া চেষ্টার গা-শিউরানো ছবি ভাইরাল হয়েছে।


    এর ওপর অতিমারির এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই চূড়ান্ত অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পাঁচটি রাজ্যে হয়ে গেল বিধানসভা নির্বাচন। নেতা-মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন রাজ্যে অসংখ্য সভা-সমাবেশ, রোড শো, জমায়েত করে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেন। এ নিয়ে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, একে পর এক হাইকোর্টের বিচারপতিরা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দিল্লি হাইকোর্টের এক বিচারপতি কেন্দ্র সরকারকে ধিক্কার জানিয়ে মন্তব্য করেছেন, “দেখে মনে হচ্ছে, আপনারা চান, মানুষ মরে যাক” (আনন্দবাজার, 28 এপ্রিল, 2021)। বিদেশের মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের মতো খ্যাতনামা সংবাদমাধ্যমগুলিতে পর্যন্ত সরকারের এই অবিবেচক ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা করা হয়েছে।


    বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত কোন ঘটনাই (তা পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়াই হোক বা সামাজিক কোনো ঘটনাই হোক) আকস্মিক বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। প্রত্যেক ঘটনায় তার পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব থাকে, তাই তা ভালো করে বুঝতে হলে, সম্পূর্ণ বিষয়টিকে ঘিরে যা কিছু চলছে সমস্তটাতেই প্রশ্ন করে করে এবং 'পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্ত' অবলম্বন করে বুঝতে হয়। তবেই গড়ে ওঠে সামগ্রিক জ্ঞান। আশা রাখব তোমরা যারা এই প্রবন্ধটা পড়লে, আশেপাশের প্রকৃতি জগতসহ তোমাদের জীবনের ক্ষেত্রেও তোমরা যুক্তি দিয়ে যতটা বোঝা সম্ভব বুঝে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাবে।


তথ্যসূত্র:-

1. worldometers.info/coronavirus

2. Covid 19: A Comprehensive Update by Dr. Chandan Kr. Sheet (Pulmonologist, CCU in charge of CHCH)

3. American Medical Association JAMA, 2020

4. আনন্দবাজার পত্রিকা


Picture Reference : 

  1. https://theindianpractitioner.com/wp-content/uploads/2021/04/Wave-nurse-graphic.jpg

Comments

  1. খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. ভীষণই সময় উপযোগী একটি লেখা , অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করলো।

    ReplyDelete
  3. Replies
    1. তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। তবে শেষের রাজনৈতিক মিশেলটুকু না থাকলে, বিজ্ঞানমনস্ক লেখা বলা যেতো।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Kadambini Ganguly: First Female Doctor in India

Electroconvulsive Therapy (ECT)

অ্যাভোগাড্রো সংখ্যা